POSTED ON July 03, 2025 by Arup Ratan Paul ভূমিকা
বর্তমান যুগে ইন্টারনেট ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা কিংবা দ্বীপাঞ্চলে এখনো নিরবচ্ছিন্ন ও দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা অনেকটাই স্বপ্ন। ঠিক এই জায়গাতেই নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে স্টারলিঙ্ক—স্পেসএক্সের তৈরি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, যা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে সক্ষম। এই ব্লগে জানবো, স্টারলিঙ্ক কী, কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা, এবং কেন এটি আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্টারলিঙ্ক কী?
স্টারলিঙ্ক হলো একটি উপগ্রহ-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যা আমেরিকান মহাকাশ প্রযুক্তি কোম্পানি স্পেসএক্স পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক। হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইট পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ঘুরছে, যেগুলো একে অপরের সাথে লেজার প্রযুক্তিতে সংযুক্ত এবং পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যাকবোনের সাথে সংযুক্ত থাকে। ব্যবহারকারীর বাড়িতে থাকে একটি ছোট ডিস অ্যান্টেনা ও রাউটার, যেটি সরাসরি স্যাটেলাইটের সাথে সংযোগ স্থাপন করে ইন্টারনেট সরবরাহ করে।

স্টারলিঙ্ক কীভাবে কাজ করে?
স্টারলিঙ্কের কার্যপ্রণালী মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত:
স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক: হাজার হাজার ছোট স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, একে অপরের সাথে ডেটা আদান-প্রদান করছে।
গ্রাউন্ড স্টেশন: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত গ্রাউন্ড স্টেশনগুলো স্যাটেলাইটের সাথে সংযুক্ত থেকে ইন্টারনেট ব্যাকবোনে ডেটা পাঠায়।
ইউজার টার্মিনাল: ব্যবহারকারীর কাছে থাকা ডিস অ্যান্টেনা ও রাউটার স্যাটেলাইটের সাথে সরাসরি সংযোগ করে ইন্টারনেট দেয়।
এই প্রযুক্তির ফলে লেটেন্সি মাত্র ২০-৪০ মিলিসেকেন্ড, যা গেমিং, ভিডিও কল বা লাইভ স্ট্রিমিংয়ের জন্য আদর্শ। গতি সাধারণত ৫০ থেকে ৩০০ এমবিপিএস পর্যন্ত, ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।
স্টারলিঙ্কের সুবিধাসমূহ
১. প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট:
যেসব জায়গায় ফাইবার অপটিক বা ৪জি পৌঁছায়নি, সেখানে স্টারলিঙ্ক একমাত্র বিকল্প হতে পারে। পাহাড়, দ্বীপ, চর, কিংবা দুর্গম গ্রামে এটি ইন্টারনেট বিপ্লব আনতে পারে।
২. সহজ সেটআপ:
কেবল ডিস অ্যান্টেনা খোলা আকাশমুখী স্থানে বসিয়ে রাউটার অন করলেই সংযোগ পাওয়া যায়। কোনো তারের ঝামেলা বা লাইনম্যানের প্রয়োজন নেই।
৩. উচ্চ গতি ও কম লেটেন্সি:
স্টারলিঙ্কের গতি এবং লেটেন্সি প্রচলিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের তুলনায় অনেক ভালো, ফলে অনলাইন ক্লাস, ব্যবসা, গেমিং, ভিডিও কলিং, লাইভ স্ট্রিমিং—সবকিছুই সহজ হয়।
৪. ব্যাকআপ সংযোগ:
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ই-কমার্স বা জরুরি সেবার জন্য এটি দুর্দান্ত ব্যাকআপ কানেকশন হতে পারে।
৫. দুর্যোগকালে যোগাযোগ:
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা বা অন্যান্য দুর্যোগে যখন মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়, তখন স্টারলিঙ্ক জরুরি যোগাযোগের একমাত্র ভরসা হতে পারে।
৬. মাল্টি-ডিভাইস সাপোর্ট:
একটি রাউটারে একাধিক ডিভাইস সংযোগ করা যায়, ফলে পুরো বাড়িতে ওয়াইফাই সুবিধা পাওয়া যায়।

স্টারলিঙ্কের অসুবিধাসমূহ
১. উচ্চ খরচ:
প্রাথমিক সেটআপ কিটের দাম প্রায় ৪৭,০০০ টাকা এবং মাসিক ফি ৪,২০০–৬,০০০ টাকা, যা বাংলাদেশের গড় আয়ের তুলনায় বেশ চড়া।
২. আবহাওয়ার প্রভাব:
ভারী বৃষ্টি, মেঘ বা ঝড়ে সিগন্যাল দুর্বল হতে পারে। বর্ষাপ্রধান অঞ্চলে এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
৩. সীমিত গ্রাহক ক্ষমতা:
একই এলাকায় বেশি ব্যবহারকারী হলে গতি কমে যেতে পারে। আরও স্যাটেলাইট স্থাপন না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা বাড়তে পারে।
৪. পরিবেশগত উদ্বেগ:
হাজার হাজার স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর ফলে স্পেস ডেব্রিস বাড়ছে, যা পরিবেশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য উদ্বেগের কারণ।
৫. প্রযুক্তিগত জটিলতা:
ডিস অ্যান্টেনা সঠিকভাবে স্থাপন ও পরিচালনা করতে কিছুটা কারিগরি জ্ঞান দরকার, যা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

বাংলাদেশে স্টারলিঙ্ক: বর্তমান অবস্থা
২০২৫ সালের মে মাসে স্টারলিঙ্ক বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। গ্রাহকরা স্টারলিঙ্কের ওয়েবসাইটে গিয়ে ঠিকানা দিয়ে অর্ডার করতে পারবেন। বর্তমানে দুটি প্ল্যান চালু আছে—"Starlink Residential" (৬,০০০ টাকা/মাস) এবং "Residential Lite" (৪,২০০ টাকা/মাস); দুটিরই এককালীন ইনস্টলেশন ফি ৪৭,০০০ টাকা। প্রতি টার্মিনাল ২০–৩০ মিটার রেডিয়াস কভার করতে পারে এবং একাধিক রুমে ব্যবহার করা যায়।
সরকার স্টারলিঙ্ককে স্থানীয় গেটওয়ের মাধ্যমে ট্রাফিক রাউট করার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে ডেটা সুরক্ষা ও আইন মানা হয়। এছাড়া, এনজিও, ফ্রিল্যান্সার ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসার জন্য বিশেষ সুবিধা এবং মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে ফিন্যান্সিংয়ের পরিকল্পনাও রয়েছে।

কেন আপনার জন্য দরকার?
উপসংহার
স্টারলিঙ্ক বাংলাদেশের ইন্টারনেট জগতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যদিও খরচ ও কিছু প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আরও সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হলে, স্টারলিঙ্ক বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রার অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
No Comments
Leave a comment